শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৪

লালন শাহের ১২৪ তম তিরোধান দিবস কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে হাজারো বাউল ভক্ত অনুরাগীদের মিলন মেলা

স্টাফ রিপোর্টার : ‘মানুষ ভজলেই সোনার মানুষ হবি’- এই স্লোগানে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১২৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী আলোচনা, সংগীতানুষ্ঠান ও লালন মেলা। ওইদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গওহর রিজভী আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন কর
েন। অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনসহ লালন গবেষকসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। লালন উৎসবের আজ ৩য় দিন। লালন মাজার পাঙ্গনে বসেছে সাধুদের হাট। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক মানব ধর্মের প্রবর্তক উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক এই সাধকের মৃত্যুর পর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় আখড়া কমিটি ও লালন একাডেমির উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান চলে আসছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবারও পাঁচ দিনব্যাপী ঐতিহাসিক এই লালন মেলার উৎ্সব পালিত হচ্ছে।
লালন ফকিরের জাতহীন মানবধর্মে দীক্ষিত হয়ে তার জীবনকর্ম, ধর্ম-দর্শন, মরমি সংগীত ও চিন্তা-চেতনা হাতড়ে তা থেকে শিক্ষা নিতে দাওয়াতপত্র ছাড়াই দিন-ক্ষণ ঠিক রেখে এবারও সাঁইজির ধামে ছুটে আসছেন ভক্ত, অনুসারী, দর্শনার্থীরা। তারা বলছেন, লালন সাঁইজির দর্শন পাওয়া, নিজেকে ও অচেনাকে চেনা, আত্মার শুদ্ধি,মুক্তি, জ্ঞান সঞ্চয় করতে বারবারই এখানে আসেন তারা।
আখড়াবাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল লালন মেলায় একতারা-দোতারাসহ হরেক রকমের পণ্যের পসরা বসিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আশপাশে ও আখড়াবাড়ি চত্বরে লালন ভক্তরা আসন গেড়ে বসেছেন। মুখে সাঁইজির বাণী। এদিকে এই অনুষ্ঠানে প্রকৃত সুরে লালনের আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লাখ লাখ লালন ভক্তকে তৃপ্তি দিচ্ছেন। লালন একাডেমির শিল্পী শিরীন আক্তার বলেন, লালনের গান বিভিন্নভাবে ও মিউজিক দিয়েও গাওয়া হচ্ছে। আমরা লালনের প্রকৃত সুর ধরে রাখার চেষ্টা করছি। আগামী পাঁচ দিন ধরে লালনের গানের আধ্যাত্মিকতা তুলে ধরা হবে তার সুরেই। এখানে আসা লালন অনুসারী বাউলদের খাদ্যসহ সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশাল এই লালন মেলার।
এ উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছরই কুষ্টিয়া শহরতলীর ছেঁউড়িয়ায় কালিনদীর পাড়ে বসে ৫ দিনের বাউল মেলা ও উৎসব। লালন একাডেমী ও বাউল শিল্পীদের দর্শনের ভাবাবেগ আর উৎসুক দর্শকদের মিলন মেলায় পরিণত হয় লালন শাহের মাজার। সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর সহযোগিতায় এ উৎসবে ছুটে আসেন হাজারো বাউল ভক্তরা। বাউল ভক্ত অনুরাগীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে লালন মাজার চত্বর।
এখন ভাববাদী গান আর সুরের মুর্ছনায় লালন শাহের আখড়া বাড়ি মাতিয়ে তুলেছে হাজার হাজার বাউল শিল্পি আর ভক্তরা। ৫দিনের লালন উৎসবকে কেন্দ্র করে লালন আখড়ায় শত শত নারী পুরুষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেছে।
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (পহেলা কার্তিক) তার মৃত্যুর পর থেকে লালন ভক্তরা এ ধারা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিবছর বাউল সম্রাট লালনের মৃত্যু বার্ষিকীতে বাউলভক্ত সাধু-গুরুরা আখড়াবাড়িতে চলে আসে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই।
তার মৃত্যুর পর থেকে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এবারও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। সাধু আঙিনায় আসন পেতে বসেছেন লালন অনুসারী-বাউলরা। সেই সঙ্গে লালন সঙ্গীতে মাতিয়ে রাখছেন সারাক্ষন।
সাধকের এই মরমী হৃদয় স্পশী বাণীর বাস্তব রুপ দিতে আজ আর শুধু দেশের ভক্ত নয় বাইরের দেশের ভক্তবৃন্দ হরহামেসা মাজার ধুলী নিতে আসতে না পারলেও জন্ম মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে সাধুর চরণ ধুলি গায়ে মাখার ঐকান্তিক ধ্যানে আসে ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে সমাহিত ফকিরের সমাধিতে। আর এই বিশেষ দিনে লালন সমাধি স্পর্শ করণে মনের বাসনা পূর্ণ করতে আসা অসংখ্য ভক্তের ভালবাসায় সিক্ত হয় কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া আখড়া বাড়িতে সমাহিত দেহত্যাগী, মরমী সাধক, আধ্যাতিœক দেহতত্ত্ববাদের অমর সাধক ফকির লালন সমাধি।
লালন একাডেমি ১৯৯০ সাল থেকে লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসে মেলা, সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও পয়লা কার্তিক থেকে অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়েছে।
একাডেমি সূত্র জানিয়েছে, এবারের আয়োজনে সারা দেশের লালনের অনুসারী ভেকধারী সাধু অংশ নিচ্ছেন। ভেকধারীরা হলেন দীক্ষাগুরু-স্থানীয় সাধু। প্রতি ভেকধারী সাধুর সঙ্গে অন্তত ২০-৩০ জন সঙ্গী এখানে আসেন।
এ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, ফ্রান্স, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের সাধুসন্ত ও লোকসংস্কৃতির অনুরাগীরা এবারের আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া সারা দেশ থেকে লালন সাঁইয়ের বিপুলসংখ্যক ভক্ত ও অনুসারী সমবেত হচ্ছেন ছেঁউড়িয়ায়।
লালনের প্রেমের কারণেই ভক্তরা ছুটে আসছেন সাইঁজির মাজারে। তার দোয়া নিতেই কুষ্টিয়ায় আসা।
লালন বাবার মৃত্যু বার্ষিকী প্রতি বছর এ সময় স্মরণ করিয়ে দেয় বাবার কথা তাই ভক্তদের এ নিরলস পরিশ্রম ছুটে আসছেন তারা লালনের বারাম খানায়।
এক সপ্তাহ ধরে বাউল মেলার প্রস্তুতি শেষে লালন উৎসবে বসেছে ফকিরদের মিলন মেলা। ফকিরদের জন্য বাড়তি প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে । হরেক রকম বাউল সরঞ্জাম নিয়ে লালনের আখড়া বাড়ি সংলগ্ন মাঠ সেজেছে বর্ণিল সাজে। গ্রামীণ মেলায় বসেছে সেখানে। মেলায় হরেক রকমের পসরা সাজিয়েছে দোকানীরা। সবমিলে বাউল উৎসব জমে উঠেছে।
৫ দিনের এ উৎসব যেন ফকিরদের প্রাণের উৎসব।
এবার এ উৎসবে যোগ দিতে বাউলরা অনেক আগে থেকে মাজার চত্বরে আসন গেড়েছেন। উৎসবে লাখো বাউল ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার লালন চত্বর। বহিরাগতদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য সকল ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানালেন লালন একাডেমী কর্তৃপক্ষ।
মানুষের পরিচয় জাত পাত ধর্মে নয়। আর এ মানুষকে ভালোবাসলেই পরমাত্মা তথা সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ সম্ভবÑলালন দর্শনের এ মূলমন্ত্র । এ লক্ষেই হাজার হাজার বাউল ভক্তদের মিলন মেলা বসেছে। লালন ভক্তদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। লালন উৎসবে মরা কালীনদীর ধারে বসেছে ফকিরদের মিলন মেলা। লাখো ভক্ত অনুসারী আর বাউল গানের শ্রোতাদের উপচে পড়া ভীড়ে মাজারে পা ফেলার জায়গা নেই। প্রতিদিনই লালনের প্রেমে ভক্তরা ছুটে আসছেন লালন মাজারে। উৎসবের শেষ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে লালন ভক্তরা জানান ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন