বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৪

৩০ শালা পানি চুক্তির ১৮ বছর অতিক্রম করলেও ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ

   খালিদ হাসান সিপাই
বাংলাদেশ ভারত পানি চুক্তির ১৮ বছরেও চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। এবারো বাংলাদেশ পদ্মা নদীর পানি অনেক কম পেয়েছে। পানি প্রাপ্যতা যাচাই করতে প্রতি বছরের ন্যায় পর্যবেণ চলছে। এতে বাংলাদেশের আশার পানি চুক্তি জন্য হতাশায় থেকে যাচ্ছে। কারণ এবারও চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছেনা। ৩০ শালা পানিচুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মা গড়াই নদীসহ ১৮টি নদী পানি শূণ্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা নদীতে পানি শূন্যতার কারণে হাডিঞ্জ ব্রীজের ১১টি স্প্যান চরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় পানির অভাবে কৃষি আবাদে দেখা দিয়েছে মরুময়তা। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুড়া ও যশোর জেলার ১৩টি উপজেলার ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হুমকীর সম্মুখীন হয়েছে। ভারতপ্রেমী সরকারের সময়েও পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলকে মরুময়তার হাত থেকে রার জন্য ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৩০ বছরের পানি চুক্তি হয়। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড় ও বাংলাদেশের প্রদানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হায়দ্রাবাদ হাউজে ঐতিহাসিক ৩০ শালা পানি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে ১লা জানুয়ারী থেকে ৩১মে পর্যন্ত ৩৬ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা। পানি চুক্তির ১৮ বছর অতিক্রম করলেও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। দু’দেশের মধ্যে চুক্তি স্বারের পর থেকেইে ভারত বাংলাদেশকে কম পানি দিয়ে আসছে। পানির অভাবে হাডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতুর নিচে জেগেছে বিশাল চর। পানি শূণ্যতার কারণে চাষাবাদসহ দণি-পশ্চিমাঞ্চলে মরুময়তা দেখা দিয়েছে। পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি কমতে কমতে পদ্মা অনেকটা খালের আকার ধারন করেছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি পিলারের মধ্যে ১১টি পিলারের নিচে পানি নেই। পানি শুকিয়ে নদীতে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। আর সেই বালু চরে চলছে চাষ আবাদ। ধু ধু বালুচরের একপাশ দিয়ে স্রোতহীন পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার শাখা উপশাখা নদীগুলোর অবস্থা আরো করুন। এ অবস্থার বাস্তব অবস্থা পর্যবেনে বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমিশনের (জে আরসি) প্রতিনিধি দল হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে পানি পর্যবেণ করে পানি প্রবাহের ফলাফল দিলেও তাতে কোন ফল আসেনি।
হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে জেগে আছে বিশাল চর, পিলারগুলো শীর্ণ ঠায় দাড়িয়ে আছে বালির উপর। পদ্মা নদীর চরে কৃষকরা আবাদ করছে বিভিন্ন সবজী ও ফসলের। আখের আবাদ হয়েছে অনেক। পদ্মার চরে এখন কৃষকদের হাল চাষের মৌসুম।
পানি না থাকায় কৃষকদের ব্যস্ততা বেড়েছে।
তথ্যসুত্রে জানাগেছে, বাংলাদেশ-ভারতের পানি চুক্তির ১৮তম বছর অতিক্রম করছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে ১০ হাজার মিটার ভাটিতে ভারত- বাংলাদেশ পানি পর্যবেণ টিম পানির প্রবাহ ও পানির স্তর পরিমাপ করে। বাংলাদেশ পদ্মা নদীর পানি এবারও ৮-১০ হাজার কিউসেক কম পেয়েছে। পানিচুক্তির ১৮ বছর অতিক্রম করলেও পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে ভারতের তাবেদারী আওয়ামী সরকারও নিরবতা পালন করছে। ফলে দেশের দণি-পশ্চিমাঞ্চল মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ৩০ বছরের পানি চুক্তি ১ জানুয়ারি ১৮তম বর্ষে পদার্পণ করছে।
হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্র জানায়, দুই সদস্যের ভারতীয় টিম ৫০ দিন ব্যাপী পর্যায়ক্রমে পদ্মার পানি পর্যবেণ করবে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম। প্রতি ১০ দিনকে একটি বা সাইকেল হিসেবে ধরা হয়। আর প্রতি ৩০ দিনকে তিনটি চক্রে ভাগ করা হয়েছে। এভাবেই পানি পরিমাপ চলবে।
চুক্তির প্রথম বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির স্তর ছিল সাত দশমিক ২৫০ মিটার। এ পয়েন্টে প্রতি বছর পানির স্তর কমে আসছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর তিন মিটারে নেমে আসে। আশঙ্কাজনকহারে পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পাবনার ২০-২৫টি নদী ইতিমধ্যে তার নাব্যতা হারিয়েছে। চুক্তির প্রথম বছরে ১ থেকে ১০ জানুয়ারি সাইকেলে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার প্রাপ্যতা ছিল ৬৭ হাজার ৫১৬ কিউসেক। সেখানে পাওয়া যায় ৭০ হাজার ১২২ কিউসেক। শর্তানুযায়ী চুক্তির প্রথম বছরের প্রথম সাইকেলে পানি পাওয়া কিছুটা বেশি হলেও পরে ভারত বাংলাদেশকে একতরফা পানি কম দিয়ে আসছে বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়।
প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকার ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২ দেশের জনগণের কল্যাণ সাধনের অভিন্ন ল্েয অনপ্রাণিত হয়ে বন্ধুত্বপূর্ন ও সুপ্রতিবেশী সূলভ সম্পর্ক উন্নয়ন এবং জোরদার করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ৯৬’র ১২ ডিসেম্বর দু’ দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় ১২ অনুচ্ছেদে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি স্বার করে। চুক্তির ১ম অনুচ্ছে অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে যে পরিমাণ পানি দিতে সম্মত হয়েছে তা ছাড়া হবে ফারাক্কায় বলে উল্লেখ করা হয়। ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয় ১লা জানুয়ারী থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন হবে এবং পরিশিষ্ট-১ এর আওতায় পানি বণ্টন ব্যবস্থায় যে ফর দাাঁড়াবে তার একটি নির্দেশমূলক তফসীল পরিশিষ্ট-২ এ দেওয়া আছে। (২) ফারাক্কার গত ৪০ বছরে (১৯৪৯-১৯৮৮) ১০ দিনের গড় পানি পানি প্রাপ্তির ভিত্তিতে পরিশিষ্ট -২ এ নির্দেশমূলক তফসীল প্রদান করা হয়েছে। ফারাক্কার ওপরে উল্লেখিত ৪০ বছরের গড় পানি প্রবাহ বজায় রাখার জন্য উজানের দেশ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। (৩) কোন ১০ দিনের সময়কালে ফারাক্কার পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে আসলে ২ দেশের সরকার কোন পরে তি না করে সমতা ও ন্যায়পরায়নতার নীতিমালার ভিত্তিতে জরুরীভাবে পানি প্রবাহে সমন্বয় সাধনের জন্যে অবিলম্বে আলোচনায় বসবে।
৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে ফারাক্কায় বাংলাদেশের জন্য যে পানি ছাড়া হবে তা ভারতের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার ছাড়া ফারাক্কা এবং গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থান যার উভয় তীর বাংলাদেশ ভূখন্ড, ২০০শত কিউসেকের বেশি হ্রাস করা হবে না।এই চুক্তি স্বারের পর সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে ২ সরকারের মনোনীত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি যৌথ কমিটি নামে অভিহিত হবে। যৌথ কমিটি হার্ডিঞ্জ ব্রীজসহ ফারাক্কা, ফারাক্কার নিচে, ফিডার ক্যানেলে ও নেভিগেশন লকে দৈনন্দিন প্রবাহ পর্যবেণ ও রেকর্ডের জন্য উপযোগী টিম গঠন করবে। বিগত সময়গুলিতে এ টিম গঠন করে বাংলাশে চুক্তি অনুযায়ী পানি পেয়ে রিপোর্ট পেশ করলেও ভারত সে ব্যাপারে কোন তোয়াক্কা করেনি।
২০১৪ সালের জন্যও ঠিক অনুরূপ পর্যবেণ টিম তৈরি করা হয়েছে ৫ সদস্যের। যারা এখন কুষ্টিয়ার হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে পর্যবেণ করছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে মে’র শেষ দিন পর্যন্ত ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল এই চল্লিশ বছরের গড় হারে বাংলাদেশ পানি পাওয়ার কথা। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ৩৫ হাজার ঘনফুট পানি প্রবাহের কথা রয়েছে। কিন্তু চুক্তির শুরু থেকেই এ পানি কম দিয়ে আসছে ভারত। তাদের ওয়াদা তারা পালন করেনি। পানিচুক্তি একটি নিষ্ফণ চুক্তিতে পরিণত হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, হিমালয়ের বরফগলা পানিতে গঙ্গা নদীর অববাহিকার আয়তন ৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০৪ বর্গকিলোমিটার। পদ্মা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজেক্টে পানির জোগান প্রতি বছর দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনমিটার। পানি প্রবাহের হার ৪ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ ঘনমিটার প্রতি ২ কিলোমিটার। ২ হাজার ৫২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় ভারত ১ কোটি ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে প্রজেক্ট) সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি (পাবনা-নাটোর ও সিরাজগঞ্জ) প্রকল্প, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করে সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। জিকে প্রজেক্টে ১ লাখ ৯৭ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার একর আবাদি জমি। যে জমিতে এখন আখ, বাদাম (যে ফসলে পানির প্রয়োজন কম হয়) চাষে ব্যস্ত রয়েছেন নদীপাড়ের কৃষক।
কুষ্টিয়ার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও পানি উন্নয়নবোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। নলকুপে পানি পাচেছনা। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কৃষি আবাদে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। এতে সেচ প্রকল্পের অধীনে ১ল ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলাসহ ৫ জেলায় মরুময়তা দেখা দিয়েছে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুড়া ও যশোর জেলার ১৩টি উপজেলায় ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা চাষীদের দূরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি চুক্তির ১৮ বছর পার হলেও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি না পাওয়ায় ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে এদেশের নদী নালা খাল বীল পানি শূণ্য হয়ে পড়েছে। ভারতের সাথে চুক্তি করে সেই চুক্তি অনুযায়ী পানি পাওয়ায় দেশের দণি-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে শুরু করেছে। হুমকীর সম্মুখীত হতে চরেছে দেশের ৫ কোটি মানুষের জীবন। দেশের মাটি ও মানুষের জীবন বাঁচাতে পানি চুক্তির যথার্থ বাস্তবায়ন করে এ সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা করবেন এটাই দেশের দণি-পশ্চিমাঞ্চল মানুষের দাবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন